যারা বিদেশ থেকে আসছেন, তাদের ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তা না মানায় অনেককে জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু হোম কোয়ারেন্টিনে কীভাবে থাকতে হয়?
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার পর উপসর্গ দেখা দিতে পারে ১৪ দিনের মধ্যে। প্রথমে জ্বর, কাশি, হাঁচি, গলাব্যথা এবং পরে শ্বাসকষ্টের মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে আক্রান্ত হলে।
যারা বিদেশ থেকে আসছেন, তাদের কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে এখনই কোনো উপসর্গ দেখা নাও যেতে পারে। কিন্তু কয়েকদিন পর লক্ষ্মণগুলো যখন স্পষ্ট হতে শুরু করবে, ততদিনে তার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যসহ বহু মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি হবে।
এই ঝুঁকি এড়াতে চিকিৎসকরা তাকে আলাদা করে রেখে পর্যবেক্ষণের কথা বলছেন, এটাই কোয়ারেন্টিনে।
বিদেশফেরত অনেককে তাদের বাড়িতে স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টিন। আর যাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশকোনা হজক্যাম্পে বা অন্য কোথাও কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে, সেটাকে বলা হচ্ছে ‘প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন।
হোম কোয়ারেন্টিনে কীভাবে থাকতে হবে, সে বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের একটি নির্দেশনা রয়েছে।
কোয়ারেন্টিনের প্রথম ও অত্যাবর্শকীয় শর্ত হচ্ছে- হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়া ছাড়া কোনোভাবে বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না। বাড়ির বাইরে কাজে, স্কুল, কলেজ অথবা জনসমাগমে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
আইডিসিআর বলছে, চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একেক জনের কোয়ারেন্টিনের সময় একেকরকম হতে পারে। তবে এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আপাতত ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে।ঘরে থাকতে হবে যেভাবে
>> আলো বাতাসের সুব্যবস্থা সম্পন্ন আলাদা ঘরে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে আলাদাভাবে থাকতে হবে। তা সম্ভব না হলে অন্যদের থেকে অন্তত এক মিটার বা ৩ ফুট দূরে থাকতে হবে।
>> ঘুমানোর জন্য রাখতে হবে আলাদা বিছানা
>> যদি সম্ভব হয় তাহলে আলাদা গোসলখানা বা টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। সম্ভব না হলে অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এমন স্থানের সংখ্যা কমাতে হবে এবং ওেই স্থানগুলোতে জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
>> বুকের দুধ খাওয়ান- এমন মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। তবে শিশুর কাছে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার এবং ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।
>> সঙ্গে পোষা পশু বা পাখি রাখা যাবে না।
মাস্কের ব্যবহার কীভাবে
>> বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে একই ঘরে অবস্থান করলে, বিশেষ করে এক মিটারের মধ্যে আসার সময় কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তি মাস্ক ব্যবহার করবেন।
>> অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
>> মাস্ক পরে থাকার সময় হাত দিয়ে ধরা থেকে বিরত থাকতে হবে।
>> মাস্কের সঙ্গে সর্দি, থুতু, কাশি, বমি লেগে গেছে সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক খুলে ফেলতে হবে এবং নতুন মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
>> ব্যবহাহৃত মাস্ক ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলতে হবে এবং সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।বিকল্প নেই হাত ধোয়ার
>> সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে। প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে।
>> অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা যাবে না।
>> সাবান-পানি ব্যবহারের পর টিস্যু দিয়ে হাত শুকিয়ে নিতে হবে। টিস্যু না থাকলে শুধু হাত মোছার জন্য নির্দিষ্ট তোয়ালে বা গামছা ব্যবহার করা যাবে। সেটি ভিজে গেলে বদলে ফেলতে হবে। আর কেউ তা ব্যবহার করবেন না।
মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি
>> কাশি শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু পেপার, মেডিকেল মাস্ক, কাপড়ের মাস্ক বা বাহুর ভাঁজে মুখ ও নাক ঢেকে রাখতে হবে এবং ২০ সেকেন্ডের নিয়ম মেনে হাত ধুতে হবে।
ব্যবহার্য সামগ্রী
>> ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করা যাবে না।
>> কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তি তার ঘরেই খাবেন। তার বাসনপত্র, থালা, গ্লাস, কাপ, তোয়ালে, বিছানার চাদর অন্য কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবে না।
>> এসব জিনিসপত্র ব্যবহারের পর সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
যা যা করতে পারেন কোয়ারেন্টিনে
>> পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ফোন, মোবাইল বা ইন্টারনেটে যোগাযোগ রাখতে পারেন
>> কোনো শিশুকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে হলে তার জন্য প্রযোজ্যভাবে বোঝাতে হবে। পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রী দিতে হবে এবং খেলনাগুলো খেলার পরে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
>> খাওয়া, হালকা ব্যায়ামের মতো দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলতে হবে।
>> বড় কোনো অসুস্থতা না থাকলে বাসায় বসে অফিসের কাজ করতে বাধা নেই।
>> বইপড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখার পাশাপাশি কোয়ারেন্টিনের নিয়মের সঙ্গে পরিপন্থি নয় এমন যে কোনো বিনোদনমূলক কাজে কোনো সমস্যা নেই।
‘হোম কোয়ারেন্টিন’ কতটা কার্যকর? সেনা পরিচালনায় কোয়ারেন্টিন আশকোনা ও দিয়াবাড়িতে সারা দেশে কোয়ারেন্টিনে ৬৩৯৩: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর |
যা মেনে চলবেন পরিবারের সদস্যরা
>> যিনি কোয়ারেন্টিনে আছেন, তিনি যাতে নিজের ঘরেই থাকেন, তা নিশ্চিত করতে হবে পরিবারের সদস্যদের।
>> বর্তমানে সুস্থ আছেন এবং ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, অ্যাজমার মত দীর্ঘমেয়াদী রোগ যাদের নেই, এমন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে পারেন। তবে তকেও নিরাপত্তার নিয়ম মানতে হবে এবং ওই ঘরে বা পাশের ঘরে থাকবেন, অবস্থান বদল করবেন না।
>> কোয়ারেন্টিনে আছেন এমন ব্যক্তির সঙ্গে কোন অতিথিকে দেখা করতে দেওয়া যাবে না।
>> কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা তার ঘরে ঢুকলে; খাবার তৈরির আগে ও পরে; খাবার আগে; টয়লেট ব্যবহারের পরে, গ্লাভস পরার আগে ও খোলার পরে এবং যখনই হাত দেখে নোংরা মনে হবে তখন পরিচর্যাকারীকে নিয়ম মেনে হাত ধুতে হবে।
>> খালি হাতে ওই ঘরের কোনো কিছু স্পর্শ করা যাবে না।
>> কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির ব্যবহৃত বা তার পরিচর্যায় ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস, টিস্যু প্রভৃতি অথবা অন্য আবর্জনা ওই ঘরে ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে রাখতে হবে। পরে সেসব আবর্জনা উন্মুক্ত স্থানে না ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
>> ঘরের মেঝে, আসবাবপত্রের উপরিভাগ, টয়লেট ও বাথরুম প্রতিদিন অন্তত একবার পরিষ্কার করতে হবে। পরিষ্কারের জন্য ১ লিটার পানির মধ্যে ২০ গ্রাম বা দুই টেবিল চামচ ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে সেটি দিয়ে ভালোভাবে মুছে ফেলতে হবে। তৈরি করা দ্রবণ সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা ব্যবহার করা যাবে।
>> কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিকে নিজের কাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে ইত্যাদি ব্যবহৃত কাপড় গুঁড়া সাবান বা কাপড় কাচা সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং পরে ভালোভাবে শুকিয়ে ফেলতে হবে।
>> নোংরা কাপড় একটি লন্ড্রি ব্যাগে আলাদা রাখতে হবে। মল-মূত্র বা নোংরা লাগা কাপড় ঝাঁকানো যাবে না এবং নিজের শরীর বা কাপড়ে যেন না লাগে তা খেয়াল রাখতে হবে।